মাথার একমুঠো চুলকে মুঠোবন্দী করে পূর্ব-পশ্চিম দিকের লম্বা বারান্দার মাঝ বরাবর পাকানো দড়ির চৌকির উপর চিন্তাগ্রস্থ মানুষটি যে রঙহীন, বিষণ্ন মুখাবয়বে মাটির দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে-তা দেখে বুকের মাঝ থেকে হু হু করে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। কী জোয়ান মানুষ! হাত পাকালে পেশির রগগুলো গর্জন দিয়ে টান টান হয়ে উঠে, পিঠের মাংস পিণ্ডগুলো চাকা চাকা হয়ে যায়, উন্নত আর প্রশস্ত বক্ষ যেন তার কালচে বোরো ধানের দিগন্তবিস্তৃত খেত। যার নিঃশ্বাসের ধমকে পথের ধূলোও খানিকটা উড়ে উঠে হচকচিয়ে। আজ সে মানুষটাই গোড়া কেটে দেওয়া লাউগাছের শুকিয়ে যাওয়া পাতার মত নিস্তেজ আর নির্জীব যেন। মরণকামড় দেয়া অসুখটা তাকে আবার চেপে ধরেছে! আগের চেয়ে আরো শক্ত করে, অজগরের মত প্রাণপণে পেচিয়ে আপাদমস্তক! এলিওপ্যাথি থেকে হোমিওপ্যাথি, তেল-পড়া, ঝাড়ফুঁক, কোনটাই কি বাদ পড়েছে! গত বছর ব্যাঙ্গালুরু গিয়ে সুস্থ হয়েছিল, ফিরে এসে ঠিক যেন বানের নয়া পানির নয়া বোয়াল মাছ! কী ছোটাছুটি আর কী দাপাদাপি! একটা বছর মানুষটা কী হেসে খেলেই না কাটালো। কিন্তু আল্লাহই আবার বুঝি তাকে পরীক্ষায় ফেলল! নইলে বছরান্তেই আবার কেন পুরনো অসুখটাই জেঁকে বসবে?
ঢাকার নামকরা ডাক্তাররা বলল, সবকিছু এখন শেষের পথে, মোজিযা ছাড়া নাকি তার বাঁচার কোন সম্ভাবনাই নেই! লাঞ্চ পুরোটাই নষ্ট! কত রাত কেঁদেকেটে আল্লাহকে শুধু ডাকলাম, মানুষটা আমার পতী, যেন আমিই চলে যাই, মানুষটাই অন্তত বেঁচে থাকুক! সেও যে দমবার পাত্র নয়। তুড়ি মেরে বলল, মরলে আমি আবার ব্যাঙ্গালুরু গিয়েই মরবো। তবুও শেষকালের মত শেষ চেষ্টা অন্তত করি। হয়তো লোকটা ভাঙলো, কিন্তু মচকালো না! যেন ব্যাঙ্গালুরগামী ট্রেনটা আবছা আবছা ভোরের আলোয় হাঁক দিয়ে প্রতিমূহুর্তে ডেকে যাচ্ছে তাকে-বেলা বয়ে গেল বলে। বাড়ির চালের চূড়ায় নকশা করা সন-তারিখের দিকে তাকালে মনে হয় ওটা যেন এক টুকরো আসমানমুখী জানালা। মানুষটা ঐ দিকেই একটানা অনেকক্ষণ উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
এমন তাগড়া জোয়ান-গার্হস্থ্য মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে আমার জীবন ছিল নদীর মত অবাধ্য আর চিন্তাহীন! সুখ ছিল, মায়া ছিল, গোলাভরা ধানের সাথে প্রাণভরা ভালোবাসাও ছিল অফুরন্ত, একটু সময়ের জন্যও কমেনি। পুকুরের খলখলিয়ে উঠা মাছের মত হৃদয়ের শান্ত দীঘিতে সুখনৃত্যও ছিল অবিরাম। কেন জানি মানুষটাকে সেবার একলা পথে ছাড়তে ইচ্ছেই করছিল না। যদিও সাথে তার মামা, চাচা দুজন সামর্থ্যবান মানুষই যাচ্ছে। হয়তো তাদের উপরে আমারও ভরসা আছে, কিন্তু মনের সায় নেই যে একেবারেই।
একটা গান শুনবা? খুব দরদ নিয়ে যাওয়ার আগের দিন রাতে বলেছিল। মনে হল তার উপরোধটাই এক পলকে এক লাইনের সুরে আমার হৃদয়াকাশে উল্কা হয়ে চমক দিয়ে গেল। বললাম, শুনাও না! গান ধরল, ‘পরের জমা, পরের জমি.......... পাশের ঘরের বড় বড় মেয়ে দুটো রাত দুপুরে বাপের এই পাগলামি দেখে এত কষ্টের মাঝেও হয়তো মুখ টিপে হাসছে! হাসুক না, সেই সন্ধ্যা থেকে বাপ-মেয়েরা কী সব মুখ আঁধার করা কষ্টের কথায় মেতে উঠেছিল, তার চেয়ে এটাই অন্তত ভাল। তার ধরা গলায় গান শুনে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম! গাঁও গেরাম দাপিয়ে বেড়ানো এই মানুষটা প্রতিটা গ্রীষ্মের রাতেই বাড়ির আঙিনায় বুড়ো-বুড়ি আর পুচকু-পিচকিদের নিয়ে গল্প-গানের পসরা সাজায়। এখন তা পারছেনা বলেই হয়তো এই সামান্য আবদার তার বউয়ের কাছে! কিছুদিন আগেও ছোট বোনগুলোর পিছনে পিছনে লেগে থাকতো, ট্যাংলাতো, দুষ্টুমি করে চড়ুই-ভাতি খেলত। এই বয়সেও এত পাগলামি যার, তাকে দেখে আমিও তার প্রতি পাগল না হয়ে পারিনি!
হ্যা গো, আমার ব্যাগ গোছানো হল? ভাবনা থেকে সম্বিৎ ফিরে পাই আমি। আমতা আমতা করে বলি, এইতো হল, আর একটু। তুমি এখন একটু ঘরের ভেতরে আসবে? আর কী কিছু বাদ পড়ল-একটু যদি দেখতে? একটু পরেই আসছি। বলেই, আঙিনায় খাবার টোকানো একটা লালরঙা বাচ্চা মোরগ দেখতে দেখতে নিমগ্ন হয়ে পড়ল আবার। কি জানি? মানুষের চারিপাশটা যখন রঙ্গিন থাকে, আলোয় আলোয় রংধনুর আকাশ ভরা রয়, তখন হয়তো অনেক দুর্লভ দৃশ্যও মানুষ অজান্তেই উপেক্ষা করে। আবার গভীর একাকীত্বে, কষ্টে এরকম অতি ক্ষুদ্র পার্থিব দৃশ্য তার কাছে অনেক দামী আর দুর্বোধ্য হয়ে উঠে। ঘরের মধ্যে এসে বিছানায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বলল, পাসপোর্ট আর ভিসা ঠিকমত দিয়েছ তো? দেখি একটু। সবগুলো লুঙ্গিই তো নতুন, তুমি আনিয়েছো, তাই না? হ্যা, আমাদের মোড়ের দোকান থেকেই। কে দেখে বলবে, এই মানুষটাও বাচ্চাদের মত নতুন লুঙ্গির প্রতি এত দূর্বল! বিড়ি-সিগারেটের কোন বাজে অভ্যেস নেই, রাত-বিরাতে বন্ধুদের সাথ পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়ার কোন খায়েশ নেই; অথচ নতুন লুঙ্গি পরলেই লোকটার চোখ-মুখে অপূর্ব দ্যুতি খেলে যায়। আর তখন ঐ মানুষটাকে দেখে আমারও চোখ-মুখ চকচক করে উঠে যে!
পরদিন সকাল বেলায় গোসল সেরে শার্ট-প্যান্ট পড়ে চোখে সুরমা লাগিয়ে দিতে বলল আমায়। সুরমা চোখে মানুষটাকে কেন জানি আরও বেশী নিষ্পাপ নিষ্পাপ মনে হয় আমার কাছে। আমি জানি প্রত্যেকবারই আমি ছাড়া তার চোখে সুরমা লাগানো কোনভাবেই ঠিক হয় না। কিন্তু সেদিন যখন সুরমা লাগাচ্ছি, একি! চোখ বেয়ে পানি কেন তার? আমিও কেঁদে ফেললাম মুহূর্তেই। সাথে সাথেই মানুষটা নিজেকে চমৎকারভাবে সামলে নিয়ে বলল, আরে, কাঁদছ কেন? এমনি, তুমি কেন কাঁদছ? কোথায়? আমি বললাম, কোথায়, না? চোখের পানি আটকাতে তো পারনি! বলল, আরে ধুর বোকা, সুরমা লাগাতে গিয়ে তুমি চোখের কোণায় মনে হয় পানের বোটা লাগিয়ে খোঁচা দিয়ে ফেলেছ- এ কারণেই মনে হয় চোখে পানি চলে এসেছে। আমি বললাম, খোঁচা তো একচোখেই লেগেছে, পানি দু চোখে কেন? আবারো বলল, ধুর পাগলি, এক চোখ একা একা পানি ফেলতে পারে নাকি, দু চোখেই তাই পানি ঝরে-এক চোখে খোঁচা লাগলেও। আমি বুঝলাম এটা তার বানানো কথা তবুও বললাম, আমার দুটো চোখের তুমিই যে একটা! এবার মনে হয়ে তার চোখেও পানি টলমল করে উঠল। সারাটা পৃথিবীর আড়ালে এই ছোট্ট গৃহে, এই মুহূর্তে দুটো মানবপ্রাণীর মাঝে যে দুর্লভ একটা অভিনয় বা নাট্য দৃশ্যায়িত হল, তা সৃষ্টিকর্তাই শুধু দেখল, জানল, অন্য সবার চোখের অজানাই রয়ে গেল।
দু-তিন দিনের টানা ট্রেন যাত্রা ব্যাঙ্গালুরুর পথে; অথচ লোকটার নাকি কিছুই মনে হয়নি। হয়তো মেঘের আড়ালে, পাহাড়ের আড়ালে সে নতুন সূর্য দেখেছিল, জীবনে ফিরে আসার! হাটুভেঙ্গে আমিও জায়নামাজে দুহাত তুলে চাই চেয়েছি আল্লাহর কাছে। যেন মানুষটি নতুন করে হাসে, কথা বলে, মুখরিত করে রাখে আদুরে ছেলে মেয়েগুলোর খেলার জগত। মামা আর চাচা তাকে কী সাহস দিবে, সেই নাকি উল্টো তাদের বলছিল, মামা, এবারের ট্রেনের যাত্রাটা বেশ আরামই তো লাগছে। মনটা তো অনেক হালকা হালকা লাগছে। আমি মনে হয় আল্লাহর রহমতে সেরেই উঠব। মামা আর চাচা মিলে আরো জোর দিয়ে তার সে কথায় সায় দেয়। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে মুখ বের করে প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে বলত, মামা, পৃথিবীটাই অনেক সুন্দর, তাই না? ডাক্তারদের দেয়া টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট, পথ্য আর ডাক্তারদের জোরালো আশ্বাস নিয়ে দিন কয়েক পরে কলকাতাগামী ফিরতি ট্রেনে উঠে পড়েছিল। সেবারের মত খুশি তাকে মামা চাচা কেউ কোনদিনও নাকি দেখেনি। কিন্তু আল্লাহ তার সে খুশি দীর্ঘায়িত করেননি আর। ট্রেনটা এসেছিল, মানুষটাকে মাঝপথে ফেলে এসেছিল অসাড় দেহসমেত। রাতেই ট্রেনের কামরায় বসে থাকতে থাকতেই হঠাৎ নাকি বলে উঠে, চাচা, আমার কেমন জানি খারাপ লাগছে। চাচা আর মামা মিলে সাথে সাথে সিটে শোয়ায়ে দেয় তাকে। কিন্তু মুহূর্তেই ওটাই হয়ে যায় তার অনন্তকালের শোয়া! শেকড়ের মাটি ছেড়ে, কাছের মানুষগুলোকে এক পলক না দেখে, কেমন করে যে মানুষটা চলে যেতে পারল-তা আজও আমার কাছে বিরাট এক প্রশ্ন।
মাঝখানে কতটা দীর্ঘ সময় বয়ে গেছে। স্মৃতিগুলোও কতকটা ঝাপসা ঝাপসা হয়ে গেছে। আমার জীবন নদী আজ শুকিয়ে যেন তপ্ত বালির বিশাল এক চর! উঠোনে আর তার গল্প-গানের পসরার কোন চিহ্ন নেই, স্বপ্নেও সে কোনদিন এসে বলে না, বউ, একটা গান শুনবা? কোন কোন জ্যোৎস্না-মাখা নিঃশব্দের রাতে একলা আমি উঠোনের শেষটায় এসে দাড়ালে, শুধু দূরের ঐ ভরা জলের নদীর তীর ঘেষে বরিন্দাদের সারি হয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট কুটীরগুলো দেখতে পাই। সেসব কুটিরে কুপি বাতির নিভু নিভু আলোগুলো কী অদ্ভুত মায়া নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি দেখি, সে আলোর প্রতিবিম্ব ছোট ছোট ঢেউয়ের বাক্সে বন্দী হয়ে ভাটির দিকে ছুটে চলছে। আমি বিস্ময় নিয়ে দেখি, তীরের আলো জলেও জ্বলে!